মাথার ওপর দিয়ে যখন উড়ে যায় তখন কি মনে হয় এই অসম্ভব কাজ মুসলমানদের দ্বারা কখনো সম্ভব?
এটা কি কখনো বিশ্বাস করতে চাইবে যে সর্বপ্রথম মুসলমানদের মাথায়ই বিমান আবিষ্কারের ধারণা আসে?
হ্যাঁ! বিশ্বাস না করলেও এটাই বাস্তব।
তাঁরাই সর্বপ্রথম বিমান আবিষ্কার করে গোটা বিশ্বেকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। আর সেটা ছিল এক এমন সময়ে যখন আকাশে উড়ার কথা কেউ ভুলেও চিন্তা করতে পারতো না। এটা তাদের কাছে ঠাট্টা বিদ্রুপের বস্তু ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
আর ইউরোপিয়ানরা! তারা তো তখনো এসব সম্পর্কে সম্পূর্ণই অজ্ঞ।
তারা ছিল তখনো ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত এক মুর্খ জাতি।
ইতিহাসে সর্বপ্রথম সফলভাবে আকাশে ডানা মেলেছিলেন যিনি তিনি হচ্ছেন ‘আব্বাস ইবনে ফিরনাস’। তিনি ৯ম শতাব্দীতে উমাইয়া খিলাফতের সময় স্পেনের আন্দালুসিয়ার একজন পলিম্যাথ বা বহুশাস্ত্র বিশারদ ছিলেন। তার উড্ডয়ন প্রচেষ্টা সম্পর্কে ঐতিহাসিক ফিলিপ কে. হিট্টি তার হিস্ট্রি অব আরব গ্রন্থে মন্তব্য করেন, “ইবনে ফিরনাসই প্রথম ব্যক্তি যিনি আকাশে ওড়ার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন বৈজ্ঞানিকভাবে।”
আব্বাস ইবনে ফিরনাসের পুরো নাম আব্বাস আবুলকাসিম ইবনে ফিরনাস ইবনে ইরদাস আল তাকুরিনি। তার জম্ম ৮১০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন মুসলিম জ্ঞানচর্চার অন্যতম কেন্দ্র স্পেনে। তিনি ছিলেন একাধারে একজন প্রকৌশলী, উদ্ভাবক, উড্ডয়ন বিশারদ, চিকিৎসক, কবি, সুরকার, পদার্থবিদ, সঙ্গীতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
তার জম্মস্থান ছিল স্পেনের রোনদায়। রোনদা এখন স্পেনের একটি পর্যটন শহর। তিনি যদিও রোনদায় জন্মগ্রহণ করেন, কিন্তু জ্ঞানের প্রতি তার আসক্তি থেকে তিনি রোনদা থেকে কর্ডোবায় গমন করেন। তবে তার আগে তিনি কিছু সময় ইরাকে ব্যয় করেন। তখন বাগদাদের দারুল হিকমাহ ছিল মুসলিম জ্ঞানপিপাসুদের তীর্থস্থান। তিনি সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর জ্ঞান আহরণ করেন ও ফিরে এসে কর্ডোবায় বসবাস শুরু করেন।
আল মাকারি উল্লেখ করেন, তিনি তার শরীরকে পালক দ্বারা আবৃত করেন এবং তার শরীরে কয়েকটি পাখা যোগ করেন। তারপর শূন্যে ভেসে পড়েন। যারা তার এই উড্ডয়ন প্রত্যক্ষ করেছেন তাদের লেখনীতে পাওয়া যায়, তিনি পাখার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য দূরত্ব অতিক্রম করেন এবং যেখান থেকে উড্ডয়ন শুরু করেছিলেন আবার সেখানে ফিরে আসেন। কিন্তু সফলভাবে অবতরণ করতে ব্যর্থ হন। এ সময় তিনি গুরুতর আহত হন।
ইবনে ফিরনাস প্রাণে বেঁচে গেলেও পিঠে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হন। তার বয়স তখন পঁয়ষট্টি বছর। এরপর তিনি তার উড্ডয়নযন্ত্রে ঠিক কী ভুল ছিল তা শনাক্তকরনে মনোনিবেশ করেন। তিনি উপলদ্ধি করেন, পাখি অবতরণের সময় লেজ এবং ডানাগুলোর সমন্বিতভাবে কার্যক্ষমের মাধ্যমে গতি নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু তিনি তার যন্ত্রে গতি কমানোর জন্য সেরকম কোনো লেজ বা বিকল্প পদ্ধতি রাখেননি।
তারপরেও তিনি প্রায় ১২ বছর বেঁচে ছিলেন। কিন্তু তার পক্ষে আর আকাশে ওড়া সম্ভব হয়নি। কারণ তিনি আর আগের মতো সুস্থতা লাভ করেননি। ৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে ইবনে ফিরনাস ইন্তেকাল করেন।
আকাশে ওড়ার এই স্বপ্নদ্রষ্টাকে স্মরণীয় করে রাখতে চাঁদের একটি জ্বালামুখের নামকরণ করা হয়েছে তার নামে। ২০১৩ সালে গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রোলস রয়েস ইবনে ফিরনাসের নামে তাদের একটি গাড়ির সংস্করণ বের করে, যার নাম দেয় ইবনে ফিরনাস মোটিফ। স্পেনের কর্ডোবায় ইবনে ফিরনাস সেতু, বাগদাদে ইবনে ফিরনাসের ভাস্কর্য, দুবাইয়ের ইবনে বতুতা মলে ফিরনাসের রেপ্লিকা ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় হয়তো ইবনে ফিরনাসের নামের সাথে পরিচয় ঘটতে পারে আপনার। তিনি বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে, তার যুগের চাইতে এগিয়ে থাকা একজন মানুষ হিসেবে।
©Abrar Mahmud