স্পেসওয়াক নিয়ে যত কথা
স্পেস শব্দের অর্থ মহাকাশ, আর ওয়াক মানে চলাচল। মহাকাশে থাকা অবস্থায় কোনো মহাকাশযান থেকে নভোচারী বের হলেই সেটাকে স্পেসওয়াক বলে। স্পেসওয়াককে অনেকসময় ইভিএ (EVA) বা এক্সট্রাভেহিকুলার অ্যাকটিভিটিও বলা হয়।
১৯৬৫ সালের ১৮ মার্চ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো স্পেসওয়াকিং করেছিলেন রাশিয়ার নভোচারী অ্যালেক্সেই লেনভ। সেই স্পেসওয়াক ছিল প্রায় ১০ মিনিট দীর্ঘ। এর কয়েকমাস পরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নভোচারী হিসেবে স্পেসওয়াক সম্পন্ন করেন এড হোয়াইট। হোয়াইট প্রায় ২৩ মিনিট ধরে স্পেসওয়াকিং করেছিলেন।
বর্তমানে নভোচারীরা সাধারণত ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন থেকেই স্পেসওয়াকিং করে থাকেন। মহাকাশে অভিযান পরিচালনা করার জন্যে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহাকাশ সংস্থার মধ্যে থাকা চুক্তি অনুসারে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন পরিচালিত হয়। যে কাজের জন্য স্পেসওয়াকিং করা হয়, তার ওপরেই নির্ভর করে নভোচারীরা কতক্ষণ সময়ের জন্য স্পেসওয়াক করবেন। তবে গড়ে প্রতিটা স্পেসওয়াকে ৫ থেকে ৮ ঘন্টা সময় লাগে।
এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি স্পেসওয়াক করে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছেন রাশিয়ার নভোচারী আনাতোলি সোলোভইয়েভ। মোট ১৬ বার স্পেসওয়াকের মাধ্যমে তিনি ৮২ ঘন্টা বা সাড়ে ৩ দিনেরও বেশি সময় মহাশূন্যে কাটিয়েছেন।
.
# নভোচারীরা কেন স্পেসওয়াকিং করে?
বিভিন্ন কারণে নভোচারীরা স্পেসওয়াক করে থাকেন। স্পেসওয়াকিংয়ের মাধ্যমে মহাকাশে থাকা অবস্থাতে মহাকাশযানের বাইরে এসে বিভিন্ন কাজ করা যায়। যেমন, যেসব বৈজ্ঞানিক গবেষণা মহাকাশযানের বাইরে এসে করতে হয়, সেসব গবেষণা করার জন্য নভোচারীরা স্পেসওয়াকিং করতে পারেন। এর মাধ্যমে মহাকাশের পরিবেশ কীভাবে বিভিন্ন জিনিসের উপরে প্রভাব ফেলে, সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা আরো পরিষ্কার ধারণা লাভ করতে পারেন।
আবার, নতুন কোনো সরঞ্জাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্যেও নভোচারীরা স্পেসওয়াকিং করে থাকেন। মহাকাশে থাকা অবস্থায় স্যাটেলাইট বা মহাকাশযানের বিভিন্ন অংশ মেরামত করার জন্য নভোচারীদের স্পেসওয়াকিং করতে হয়। এতে করে কোনো যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ মেরামত করার জন্য পৃথিবীতে বয়ে নিয়ে আসার দরকার হয় না।
.
# কীভাবে স্পেসওয়াকে যান নভোচারীরা?
স্পেসওয়াকিংয়ের আগে নভোচারীরা মহাকাশে চলাফেরা করার বিশেষ পোশাক বা স্পেসস্যুট পরেন। স্পেসস্যুটের ভেতরে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পান করার জন্য পানির ব্যবস্থা থাকে।
স্পেসওয়াকে যাওয়ার কয়েক ঘন্টা আগে নভোচারীরা স্পেসস্যুট পরেন। এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাস প্রবেশ করানোর মাধ্যমে স্পেসস্যুটের বায়ুচাপ নিয়ন্ত্রিত থাকে। স্পেসস্যুট পরার পরে কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত নভোচারীরা তাদের নিঃশ্বাসের সাথে বিশুদ্ধ অক্সিজেন গ্রহণ করেন।
শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে শুধুমাত্র অক্সিজেন গ্রহণ করার ফলে নভোচারীদের দেহে থাকা নাইট্রোজেন দূর হয়ে যায়। শরীরে থাকা নাইট্রোজেন যদি দূর না করা হয়, মহাশূন্যে চলাফেরা করার সময় নভোচারীদের শরীরে গ্যাসের বুদবুদ তৈরি হতে পারে। গ্যাসের এই বুদবুদগুলি তৈরি হলে নভোচারীরা নিজেদের কাঁধ, কনুই, কবজি এবং হাঁটুর মতো অংশে ব্যথা অনুভব করতে পারেন। যাদের দীর্ঘ সময় পানির নীচে থাকতে হয়, একই কারণে তাদেরও এধরনের ব্যথা হতে পারে।
স্পেসওয়াকের জন্য প্রস্তুত হওয়ার পর নভোচারীরা ‘এয়ারলক’ নামের বিশেষ দরজা দিয়ে মহাকাশযান থেকে বের হন। ‘এয়ারলক’ ব্যবস্থায় সাধারণত দুটি দরজা থাকে। নভোচারীরা যখন মহাকাশযানের ভেতরে থাকেন, তখন এয়ারলকের বায়ুরোধী দুটি দরজাই বন্ধ থাকে।
স্পেসওয়াকে যাওয়ার সময় নভোচারীরা আগে এয়ারলক এর প্রথম দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন। বের হওয়ার পরপরই দরজাটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপরে দ্বিতীয় দরজা খুলে নভোচারীরা মহাকাশযান থেকে বের হন। এতে করে মহাকাশযান থেকে কোনো বায়ুই বাইরে বের হতে পারে না। স্পেসওয়াক শেষেও মহাকাশচারীরা একইভাবে মহাকাশযানে প্রবেশ করেন।
.
# স্পেসওয়াকের সময় নভোচারীরা নিরাপদ থাকেন কীভাবে?
স্পেসওয়াকিংয়ের সময় নভোচারীরা বিশেষভাবে তৈরি একধরনের নিরাপত্তা রজ্জুর মাধ্যমে মহাকাশযানের কাছাকাছি থাকেন। এই নিরাপত্তা রজ্জু আসলে দড়ির মতোই কাজ করে। এর একপ্রান্ত স্পেসওয়াকিং করতে থাকা নভোচারী, আরেক প্রান্ত মহাকাশযানের সঙ্গে যুক্ত থাকে। নিরাপত্তা রজ্জু দিয়ে সংযুক্ত থাকার ফলে মহাকাশে ভেসে ভেসে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার ভয় থাকে না। নভোচারীরা তাদের সরঞ্জাম বা যন্ত্রপাতি নিজেদের কাছে রাখার জন্যেও নিরাপত্তা রজ্জু ব্যবহার করে থাকেন। স্পেসওয়াকিংয়ের সময় সাধারণত নভোচারীদের কাছে থাকা জিনিসপত্র তাদের স্পেসস্যুটের সাথে নিরাপত্তা রজ্জুর মাধ্যমে যুক্ত থাকে।
স্পেসওয়াকিংয়ের সময় নিরাপদে থাকার জন্য নভোচারীরা SAFER নামের একটি গ্যাজেটও ব্যবহার করেন। SAFER এর পূর্ণরূপ হলো, ‘সিম্পলিফায়েড এইড ফর ইভিএ রেসকিউ’। গ্যাজেটটি ব্যাকপ্যাকের মতো নভোচারীদের পিঠে ঝোলানো থাকে। এর মধ্যে ছোট আকারের জেট থ্রাস্টার থাকে, যেটি ব্যবহার করে নভোচারীরা মহাশূন্যে অল্প দূরত্বে চলাফেরা করতে পারেন। কারো সাথে সংযুক্ত নিরাপত্তা রজ্জু যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে SAFER এর মাধ্যমে তিনি মহাকাশযানে ফেরত আসতে পারেন। ভিডিওগেম খেলার জন্য যেভাবে ব্যবহার করা হয়, সেভাবেই ছোট্ট একটি জয়স্টিকের সাহায্যে SAFER নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
.
# নভোচারীরা স্পেসওয়াকিংয়ের জন্যে প্রশিক্ষণ নেয় কীভাবে?
স্পেসওয়াকিং করার আগে নভোচারীদের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। আর প্রশিক্ষণ নেয়ার অন্যতম উপায় হলো, সাঁতারের মাধ্যমে শেখা। মহাকাশে ভেসে থাকা অনেকটা পানিতে ভেসে থাকার মতোই। নভোচারীরা সাধারণত বিশাল আকারের সুইমিং পুলে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন।
নাসা’র নভোচারীরা যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত ‘নিউট্রাল বুয়োন্সি ল্যাবরেটরি’ নামের একটি বিশাল পানিঘেরা স্থানে প্রশিক্ষণ নেন। সেখানে প্রায় ৬.২ মিলিয়ন গ্যালন পানির মধ্যে নভোচারীরা প্রতি ১ ঘন্টা স্পেসওয়াকিং এর জন্য ৭ ঘন্টা প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন।
স্পেসওয়াকিংয়ের জন্য প্রশিক্ষণ নেয়ার আরেকটি উপায় হলো ভার্চুয়াল রিয়ালিটির মাধ্যমে অনুশীলন। এটা অনেকটা ভিডিওগেম খেলার মতো। এভাবে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য নভোচারীরা প্রথমে ভিডিও স্ক্রিন সংযুক্ত একটি হেলমেট এবং বিশেষভাবে তৈরি একধরনের গ্লাভস পরেন।
স্পেসওয়াকিং এর সময় তারা যা দেখতে পান, তার একটি চিত্র হেলমেটের মধ্যে থাকা স্ক্রিনে চলতে থাকে। আবার, গ্লাভসের মাধ্যমে নভোচারীদের শরীরের নড়াচড়াও হেলমেটের মাধ্যমে দেখা যায়। ফলে নভোচারীদের কাছে এই ভার্চুয়াল রিয়ালিটি সিমুলেশন প্রযুক্তি সত্যিকারের স্পেসওয়াকের মতোই মনে হয়।
.
ছবি. নভোচারী এডওয়ার্ড এইচ. হোয়াইট দ্য সেকেন্ড। তিনি ছিলেন মহাকাশযান জেমিনাই-টাইটান 4 (বা জিটি-4) এর পাইলট। জিটি-4 মহাকাশযানটির তৃতীয় আবর্তনের সময় মাধ্যাকর্ষণের অনুপস্থিতিতে মহাশূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছেন তিনি।
ছবি সৌজন্য. নাসা