সবাই মা কে ভালবাসি তাহলে বৃদ্ধাশ্রমে মায়েদের ভীড় কেনো?

‘মা’ – ছোট্ট একটা শব্দ, কিন্তু তার বিশালতা অনেক বেশি। সৃষ্টির সেই আদিলগ্ন থেকে মধুর এই শব্দটা শুধু মমতার নয়, ক্ষমতারও যেন সর্বোচ্চ আধার৷ মায়ের অনুগ্রহ ছাড়া কোনো প্রাণীরই প্রাণ ধারণ করা সম্ভব নয়৷ তিনি আমাদের গর্ভধারিনী, জননী৷ জন্মধারিনী হিসেবে আমার, আপনার, সকলের জীবনে মায়ের স্থান সবার ওপরে ৷

 

তাই শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জানানোর জন্য একটি বিশেষ দিনের হয়ত
প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ব মা দিবস পালিত হয়৷ নানা সূত্র থেকে জানা গেছে, প্রথম মা দিবস উদযাপন শুরু হয় গ্রিসে৷ ১৯১৩ সালে অ্যামেরিকান কংগ্রেস মা দিবসকে সরকারিভাবে পালনের অনুমতি দেয়৷ তারপর থেকেই বিভিন্ন দেশে মা দিবস উদযাপন শুরু হয়৷ তবে মা দিবস উদযাপনের প্রথম ভাবনাটি এসেছে অ্যামেরিকান সমাজকর্মী জুলিয়া ওয়ার্ডের মাথা থেকে৷

বার্তমান সময়ে মা দিবস আসলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরব হয়ে ওঠে মায়ের সাথে ছবি আপলোড করে। কিন্তু সেই মাকে সারাবছর একবারও শুভেচ্ছা বা ভালবাসার কথা বলা হয় না। ঢাকাসহ সারাদেশে অনেক বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই হয়েছে মায়েদের। তেমনি একটি বৃদ্ধাশ্রমের মায়েদের সাথে কথা বলার সুযোগ হয় আমার।

ব্রিটিশ আমল থেকে পরিবারের সদস্যরা থাকতেন লন্ডনে। এই সালেমা আমজাদের জন্মও লন্ডনে। তার শৈশব-কৈশোর- পড়াশোনা আর বেড়ে উঠা সবই ওই শহরে। তারুণ্যের দিনগুলোও কেটেছে যুক্তরাজ্যের রাজধানীতেই। পরে বিয়ে, চার সন্তানের জননী হওয়া; সেও ওই লন্ডনে। জীবনের দীর্ঘ সময় স্বামী আর চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে সুখ-স্বাচ্ছ্যন্দময় জীবন কাটিয়েছেন তিনি। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে পৌছে ৬৫ বছর বয়সী সালেমা আমজাদের ঠিকানা হয়েছে ঢাকার চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার বৃদ্ধাশ্রমে।

রাজধানীর কল্যাণপুরের চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড কেয়ার সেন্টারে আড়াই বছর ধরে আছেন অবহেলিত এই মা। সেখানেই ফেলে আসা সোনালী দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করে কাটাচ্ছেন তিনি দিনরাত। এখানে আশ্রয় নেওয়ার পর সন্তানদের কেউ একবারের জন্যও তাকে দেখতে আসেননি। অথচ এই চার সন্তানকে বড় করে তুলতে নিজের জীবনটাই উৎসর্গ করেছিলেন সালেমা আমাজাদ।

সম্মানজনক বেতনের চাকরি পেয়েও সন্তানদের দেখভাল করতে গিয়ে তাতে যোগ দেওয়া হয়নি তার। পুরো সময়টায় সালেমা সন্তানদের দিয়েছেন। সন্তানরা ক্রমে বড় হয়ে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে একপর্যায়ে খুব ভালো ভালো কাজের সুযোগ পান। চাকরিবাকরি, সংসার, সন্তানসহ নিজেদের মতো গুছিয়ে ফেলেন যার যার জীবন। শুধু তাদের কারো পরিবারেই জায়গা হয়নি বয়স্ক মা সালেমার। ছেলেমেয়ে সবার কাছেই তিনি থেকে গেছেন উপেক্ষিত।

চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড কেয়ারে ওনার মতো এ রকম ৭৩ জন বৃদ্ধ মা-বাবার খোঁজ মেলে। তাঁদের অনেকেই বিভিন্ন সময় রাষ্ট্র ও সমাজের নানান গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেখা মিলল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরও। জীবনের সবকিছু উজাড় করে তারা একদিন নিজেদের সন্তানদের পড়ালেখা শিখিয়ে দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, আর আজ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে উপেক্ষিত তাদের আশ্রয় হয়েছে এই বৃদ্ধাশ্রমে।

যে মা-বাবা আমাদের আঙুল ধরে হাঁটতে শিখিয়েছে, কথা বলতে শিখিয়েছে, মুখে তুলে দিয়েছে অন্ন, সেই বাবা-মা বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে, তাঁদের হাতে গড়া সন্তানটি ছোটবেলার কথা ভুলে বাবা-মা কে পাঠিয়ে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে৷

আমরা তো দেশকেও ‘মা’ বলে ডাকি৷ দেশের মাটিকে মা জ্ঞান করে তাঁর পায়ে মাথা ঠেকাই আমরা৷ বড় গলায় গর্ব করি দেশমাতৃকার জন্য৷ কিন্তু নিজের মায়ের বেলায়?

বেঁচে থাকতে কতদিন, কতবার তাঁকে আদর করেছি আমরা? কতবার বলেছি

 

‘মা, তোমায় ভালোবাসি’?

 

জীবনচক্রের ঘূর্ণন শুরু হয় সেই জন্মলগ্ন থেকে৷ এরপর ছোটবেলা কাটিয়ে উঠে কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য, আর সবশেষে অনিবার্য মৃত্যু৷ এই ধ্রুব সত্য শুধু আপনার-আমার নয়, সবার জন্য৷ তাই দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিন৷ যতদিন ‘মা’ বেঁচে আছেন, ততদিন, প্রতিটি দিন পালন করুন ‘মা দিবস’ হিসেবে৷

 

 

সাহারিয়া মজুমদার সাব্বির

About Saharia Mazumder

Check Also

ক্লাসে মনোযোগী হবার ৮টি সহজ উপায়!

ক্লাসে মনোযোগী হবার ৮টি সহজ উপায়!

ক্লাসে মনোযোগী হবার ৮টি সহজ উপায়!  সরিয়ে ফেলো মনোযোগ নষ্টের হাতিয়ার: আমাদের ক্লাসে মনোযোগী হবার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *