নক্ষত্রের পরিনতি
নিউট্রন স্টার
আজকের লেখায় অনেক মজার মজার তথ্য থাকবে লেখাটা একটু বড় হবে সবাই ধৈর্য নিয়ে পড়বেন আশা করি।
গত পর্বে বলেছিলাম ছোট থেকে শুরু করে ১.৪ সৌরভর সমান তারার মৃত্যুতে তৈরি হয় শ্বেত বামন কিন্তু ১.৪ এর বেশি ভরের তারা গুলোর কি হয়?? ১.৪ থেকে ৮ গুন পর্যন্ত সৌর ভরের তারা গুলো মারা যাবার সময় লোহিত দানব হয় ঠিকই কিন্তু আকারে হয় বিশাল তাই একে বলা হয় রেড সুপার জায়ান্ট বা অতিকায় লোহিত দানব তখন মাধ্যাকর্ষণ এর চাপে তারাটি আরো সংকুচিত হতে থাকবে এবং ভিতরের তাপ বাড়তে বাড়তে এমন পযার্য়ে আসবে যে প্রচণ্ড চাপ ও তাপে ফিউশনের ফলে হাইড্রোজেন > হিলিয়াম > লিথিয়াম…… এভাবে পর্যায়ক্রমে ভারী মৌল তৈরি হতে হতে লোহা উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ লোহা আমাদের পৃথিবীর কোনো পদার্থ নয় লোহার একটা অণু বানাতে যে পরিমান চাপ ও তাপের প্রয়োজন তা আমাদের গ্রহ তো দূর আমাদের সৌর জগতে ও সম্ভব নয়,, এখানে একটা ছোট কথা বলে রাখি প্রকৃতিতে পাওয়া মৌলিক পর্দাথের বেশিরভাগই কিন্তু এই নক্ষত্র থেকে আসা। আমাদের বেচে থাকার অপরিহার্য উপদানগুলো যেমন ক্যালসিয়াম ম্যাগনেসিয়াম সহ ইউরেনিয়াম প্লাটিনাম সোনা ইত্যাদি প্রায় সব ভারি মৌলিক পদার্থের জন্ম কোনো না কোনো নক্ষত্রে একটা বার ভাবুন তো আমাদের শরিরে ভেতরে থাকা ক্যালসিয়াম লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে কোনো নক্ষত্র বিষ্ফোরনের ফল।
আমাদের আশেপাশে যত চমৎকার ও জটিল মৌল দেখা যায় তার সবই সুদূর অতীতে কোনো এক নিউট্রন স্টারের মৃত্যুর সময়ে তৈরি হয়েছিল। মানুষ ও সম্পূর্ণ প্রাণীজগতের দেহ যে বস্তুগুলোর সমন্বয়ে তৈরি, তা কোনো এক সময়ে নক্ষত্রের ভেতরে ছিলো আমাদের সম্পূর্ণ প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও সভ্যতা গড়ে উঠেছে এই বৈচিত্র্যময় পরমাণুগুলোর সমন্বয়ে যা ১০ বিলিয়ন বছর ধরে এই চিরচেনা সৌরজগত ও আমাদেরকে তৈরি করছে। যাই হোক মৌল তৈরি হতে হতে লোহা পর্যন্ত তৈরি হয় কিন্তু লোহা তৈরি হবার পরে তা বাইরের কোন বল ছাড়া ফিউশনের মাধ্যমে আর ভারী কোন মৌলে রুপান্তরিত হতে পারেনা। তখন প্রচণ্ড কেন্দ্রাভিমুখী চাপ ও তাপে ইলেকট্রন ও প্রোটন মিলিত হয়ে নিউট্রনে পরিণত হয়, যা স্বল্প সময়ের জন্যে হঠাৎ করে কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ বন্ধ করে দেয় এবং শুধু বহির্মুখী বলের প্রভাবে নক্ষত্রের বাইরের স্তর সুপারনোভা হিসেবে বিস্ফোরিত হয়। এই সুপারনোভাকে বলা হয় প্রকৃতির সবচেয়ে দর্শনীয় বিস্ফোরণ! এই তাপে তারাটিতে একটি প্রচন্ড বিস্ফোরন ঘটবে , এবং তারাটির বাইরের অংশ ছিটকে মহাকাশের বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পরবে । একে বলে সুপার নোভা ( Super nova ) বা নব তারা । এই বিস্ফোরনের আলো এতই উজ্জল হয় যে একটি গ্যালাক্সির উজ্জলতাও এর কাছে কিছুই না । যদিও এই উজ্জলতা বেশী সময় স্হায়ী হয় না । যদি আমাদের গ্যালাক্সিতে মানে মিল্কিওয়েতে এমন সুপারনোভা বিষ্ফোরনের ঘটনা ঘটে তবে আমাদের পৃথিবীতে তার আলো দিনের আলোর চাইতে অনেক গূণ উজ্জ্বল হবে। আমাদের মহাবিশ্বের প্রায় সমস্ত উপদানই এসেছে এই সুপারনোভা থেকে মানে এই তারার বিষ্ফোরন থেকে। এই সুপারনোভা বিষ্ফোরনের পর নক্ষত্রের যে অবশিষ্ট কোর থাকে সেটাই নিউট্রন নক্ষত্র বা তারা। এর আকার থাকে অনেক ছোট ১০০-২০০ কিলোমিটার ব্যাস হয়। এর উপদান শুধু নিউট্রন কণা। এই তারার অভিকর্ষ ভর আর ঘনত্ব দুটোই বেশি। এর অভিকর্ষ বল আমাদের পৃথিবীর প্রায় কয়েক হাজার গুণ, পৃথিবীতে আপনার ওজন ১০০ কেজি হলে সেখানে আপনার ওজন হবে ১ লক্ষ কেজিরও বেশি। এত বেশি অভিকর্ষের কারণে এটা আলোর রেখাকেও বাকিয়ে নিজের দিকে নিয়ে যায়। অর্থাৎ এর পাশ দিয়ে যদি সরল রেখায় কোনো আলো যায় তবে সেই আলোর রেখাকে নিজের দিকে টেনে নিতে সক্ষম। আর ঘনত্বের কথা যদি বলি নিউট্রন তারার ১ চামচ পদার্থের ওজন হবে আমাদের পৃথিবীতে প্রায় ৬০ থেকে ১০০ কোটি টন। আমাদের হাত থেকে কোন বস্তু পরে গেলে সেটা বাতাস ভেদ করে যেভাবে মাটিতে পরে যায় নিউট্রন তারার ১ চামচ পদার্থ তেমনি পৃথিবীর মাটিতে পরলে মাটি ভেদ করে অপর প্রান্ত দিয়ে মহাকাশে চলে যাবে। নিউট্রন তারা হবার পর এর পরিনতি কি? নিউট্রন তারা হবার পর সাধারণত এর আর পরিবর্তন হয় না, এই নিউট্রন তারার পৃষ্ঠে সামান্য পরিবর্তন আসতে ট্রিলিয়ন বছর লাগবে যেখানে আমাদের মহাবিশ্বের বয়স মাত্র ১০ বিলিয়ন বছরের একটু বেশি। নিউট্রন নক্ষত্রের আরো একটি পরিবর্তন হয় সেটা হলো দুটো নিউট্রন নক্ষত্র পাশাপাশি থাকলে দুটি একে অপরকে আকর্ষণ করে একটি অরবিটে ঘুরতে থাকে এমন দুটি তারা একসাথে ঘুরতে থাকাকে বলা হয় বাইনারি নিউট্রন আরো একটি তথ্য হলো এই নিউট্রন স্টারের অবর্তন মানে ঘুরার বেগ অনেক বেশি সেকেন্ডে প্রায় ৭০০-১০০০ বার। অথাৎ ৭০০-১০০০ বার সেকেন্ডে রাত দিন দেখার মতো ব্যাপার এই ভাবে দুটো নিউট্রন তারা ঘুরতে ঘুরতে একসময় বিষ্ফোরন হয় যাকে বলে কিলোনোভা বিষ্ফোরন। সুপারনোভা ও কিলোনোভা বিস্ফোরণে নিউট্রন স্টার থেকে ছিটকে বের হওয়া পরমাণুগুলো অনেক মিলিয়ন বছর ধরে গ্যালাক্সির মধ্যে ভেসে বেড়ায়। এদের কেউ হয়তো ধীরে ধীরে মেঘের মতো একটা আস্তরণ তৈরি করে, যেটি মহাকর্ষের প্রভাবে নিজেদের মধ্যে একত্রিত হয়ে নতুন কোনো নক্ষত্রের জন্ম দেয়। এর আশেপাশে অনেকগুলো গ্রহ তৈরি হয়ে সে নক্ষত্রকে ঘিরে ঘুরতে থাকে। আমাদের সৌরজগত এমনই একটি উদাহরণ। বিগত বিশ বছর ধরে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল স্যাটেলাইট, কমপিউটার, রেডিও টেলিস্কোপ প্রভৃতি যন্ত্রের সাহায্যে জ্যোর্তিবিজ্ঞানীরা নিউট্রন নক্ষত্রের গঠন রহস্য নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে এ সম্বন্ধে আরও বহু তথ্য আমরা জানতে পারবো।