কৃত্রিম বৃষ্টিপাত হলো প্রকৃতির ওপর বৈজ্ঞানিক প্রভাব খাটিয়ে সংঘটিত বৃষ্টিপাত। এ জন্যে প্রথমতঃ মেঘ সৃষ্টি করতে হয়; দ্বিতীয় পর্যায়ে এই মেঘকে বৃষ্টিপাতের উপযোগী অবস্থায় নিয়ে আসতে হয় এবং শেষতঃ মেঘ গলিয়ে বৃষ্টি ঝরানো হয়। তবে সচরাচর আকাশে ভাসমান মেঘকে পানির ফোঁটায় পরিণত করে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানো হয় ।
কেমন হয় যদি কৃত্রিমভাবে করা যায় বৃষ্টিপাত । ঠিক এই কথাই প্রথম ভেবেছিলেন মার্কিন বিজ্ঞানী ভিনসেন্ট শায়েফার। তিনি বাতাসের জলীয় বাষ্পকে জমাট বাঁধিয়ে মেঘ বানাতে ব্যবহার করেছিলেন জমাট বাঁধা কার্বন ডাই অক্সাইডের টুকরা (Dry Ice)। তিনি বার্কশায়ার পাহাড়ের কাছে ড্রাই আইস ছুঁড়ে দিয়ে তুলোর মতো মেঘ বানাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই তাঁকেই কৃত্রিম মেঘের জনক বলা হয়ে থাকে।
বাতাসের ঘনীভবন
প্রথম পর্যায়ে যেখানে বৃষ্টিপাত আবশ্যক সেখানে রাসায়নিক ব্যবহার করে মেঘ সৃষ্টি করা হয়। ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ক্যালসিয়াম অক্সাইড, ইউরিয়া এবং লবণ মিশ্রিত একটি রাসায়নিক অথবা ইউরিয়ার সঙ্গে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মিশিয়ে প্রস্তুত একটি রাসায়নিক মেঘ সৃষ্টিতে ব্যবহার করা হয়। এই রাসায়নিক বায়ু থেকে আর্দ্রতা আহরণকরত ঘনীভবন প্রক্রিয়ার সূত্রপাত ঘটায়।
মেঘসৃষ্টি
দ্বিতীয় পর্যায়ে রাসায়নিকের সাহায্যে মেঘপুঞ্জ তৈরি করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় রান্নার লবণ বা সোডিয়াম ক্লোরাইড, টি-১ ফর্মুলা, ইউরিয়া, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, শুকেনো বরফ এবং কখনো কখনো ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড ব্যবহার করা হয়। এতে মেঘের দ্রুত ঘনীভবন হয় এবং তা পতনশীল অবস্থায় পৌছেঁ।
বৃষ্টিপাত
তৃতীয় পর্যায়ে বিমানের সাহায্যে মেঘরাশির ওপর সিলভার আয়োডাইড নামক রাসায়নিক পদের্থের স্ফটিকদানা (বা কখনো কখনো বিচূর্ণ শুকেনো বরফ) ছড়িয়ে দিয়ে মেঘধৃত আর্দ্রতাকে বড়-বড় পানির ফোঁটায় পরিণত করা হয় যা আর বাতাসে ভাসতে না-পেরে মাটিতে নেমে আসে এবং বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়। বিকল্পে, মেঘপুঞ্জ লক্ষ্য করে রাসায়নিকপূর্ণ রকেট ছোঁড়া হয়ে থাকে।
মেঘ আছে বৃষ্টি নেই
প্রায়শঃ এমন অবস্থা দেখা যায় যে আকাশে মেঘ আছে অথচ বৃষ্টি হচ্ছে না। অতি শীতল মেঘে তুষার কণা জমে যায়, পানি আর থাকে না। তখন বিমান থেকে রাসায়নিক ছিটিয়ে অতি শীতল (সুপারকুলিং) অবস্থা নষ্ট করে দেয়া হয়; মেঘ তখন পানিতে পরিণত হয় এবং বৃষ্টির ফোঁটায় মাটিতে নিপতিত হয়।
সূর্যের তাপে বিভিন্ন পুকুর, নদী, সাগরের পানি জলীয়বাষ্পে পরিনত হয় । সেই জলীয় বাষ্প হালকা হওয়ার কারণে উপরে উঠে গিয়ে বাতাসের ধূলিকণা, বালুর কণা ইত্যাদির সহায়তায় জমাটবদ্ধ হয়ে তৈরি করে মেঘ। এভাবে মেঘের আকৃতি বড় হতে হতে যখন ভারি হয়ে যায়, তখন হয় বৃষ্টি। এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটিকে মানবনিয়ন্ত্রীত পন্থায় করাকেই বলা হচ্ছে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত।
কৃত্রিম বৃষ্টিপাতে, কখনও পুরো প্রক্রিয়াটি, কখনও তার আংশিক (জলীয় বাষ্পকে মেঘে রূপান্তর) নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পুরো প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রথমে দ্রুতগতির বড় পাখা দিয়ে কোনো জলক্ষেত্রের পানিকে বাষ্পিভূত করা হয়। হালকা সেই বাষ্প উপরে উঠে গিয়ে বাতাসের ধূলিকণার সাথে মিশে জমাট বাঁধে।
তবে এই জমাট বাঁধানোর ব্যাপারটিও কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সিলভার আয়োডাইডের কণা ছুঁড়ে দিয়ে। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিমভাবে তৈরি জলীয় বাষ্পকে জমানোর জন্য বন্দুক কিংবা রকেট ব্যবহার করে ভূমি থেকে উপরের দিকে, কিংবা বিমান ব্যবহার করে আকাশ থেকে ভূমির দিকে সিলভার আয়োডাইডের কণা ছড়িয়ে দেয়া হয়।
উষ্ণ অঞ্চলে একাজে ব্যবহার করা হয় ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড।এভাবে জমাটবদ্ধ জলীয় বাষ্প বা মেঘ যখন ভারি হয়ে যাবে, তখন ঐ স্থানে ঝরে পড়বে মেঘ, হবে বৃষ্টি। কৃত্রিম বৃষ্টির এই প্রক্রিয়া যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ।
কৃত্রিম বৃষ্টি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আশার বাণী নিয়ে এসেছে। সবচেয়ে বেশি উপকৃত হচ্ছে চীন।
চীনের উত্তর অংশে বৃষ্টিপাত সাধারণ খুব কম হয়। পানির অন্যান্য উৎসগুলোর অবস্থাও ভয়াবহ খারাপ। তাই কৃত্রিম বৃষ্টি কাজে লাগিয়ে তারা ইচ্ছামতো বৃষ্টি ঝরিয়ে নদ-নদীর পানি ১৩% পর্যন্ত বাড়াতে সক্ষম হয়েছে ।
দুবাইয়ে কৃত্তিম বৃষ্টি ঘটানো:
এখন দুবাইয়ের তাপমাত্রা গড়ে প্রতিদিন ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে থাকছে। গরমে নাভিশ্বাস মানুষের। এমন পরিস্থিতিতে দেশটির সরকার সিদ্ধান্ত নেয় কৃত্রিম বৃষ্টি তৈরির। এটি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিজ্ঞানীরা। নতুন প্রক্রিয়ায় বৃষ্টি নামান তারা।
জেপার ড্রোন থেকে কৃত্রিমভাবে বৈদ্যুতিক চার্জ ব্যবহার করে আবহাওয়া পাল্টে দেন তারা। ফলে মরুর দেশটিতে দেখা মেলে বৃষ্টির। বলা চলে, জোর করেই বৃষ্টি নামিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান বৃষ্টিপাতের অফিসিয়াল ভিডিও প্রকাশ করেছেন দুবাইয়ের আবহাওয়া কর্মকর্তারা। বিজ্ঞানীরা নতুন যে প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছেন, সেটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে গোটা বিশ্বের জন্য। আগের প্রক্রিয়াগুলোর মতো পরিবেশের ওপর বেশি প্রভাব না ফেলেই অনাবৃষ্টি কমাতে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে নতুন প্রক্রিয়াটি ।