কম্পিউটার বিজ্ঞানের পড়ালেখা
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করার পরে শিক্ষার্থীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তখন তাদের মধ্যে অনেকেই কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়টি বেছে নেয়। কম্পিউটার বিজ্ঞান কিংবা কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়টি শিক্ষার্থীদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে নানান কারণ থাকে। কেউ কম্পিউটার বিজ্ঞানী হতে চায়, কেউ হতে চায় সফটওয়্যার নির্মাতা, কেউবা হয়তো কম্পিউটারে গেম খেলতে পছন্দ করে তাই কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়তে আসে! আবার অনেকেই কিছু না বুঝে এমনি এমনি ভর্তি হয়—অনেকটা খুশিতে, ঠ্যালায়, ঘোরতে আর কি। তাই ভার্সিটির চার-পাঁচ বছরের শিক্ষাজীবনে একেকজনের একেক রকম অভিজ্ঞতা হয়।
প্রোগ্রামিং
কম্পিউটার সায়েন্স বা সিএস পড়তে এসে যারা প্রথমবার প্রোগ্রামিং শেখা শুরু করে, তারা সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খায়। কারণ প্রোগ্রামিং শেখা অন্য অনেক কিছুর চেয়েই আলাদা— স্কুল-কলেজের মতো লেখাপড়া করে এটা শেখা যায় না। আবার প্রোগ্রামিং শেখানোটাও অন্য অনেক বিষয় পড়ানোর চেয়ে একেবারেই আলাদা। সকল শিক্ষক এ বিষয়ে সমানভাবে দক্ষ নন। তাই এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে এবং তাদের ভেতরে প্রোগ্রামিং নিয়ে ভয় ঢুকে যায়, যেটি কাটিয়ে ওঠা অনেকের পক্ষেই আর সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের যা করতে হবে তা হলো—
- আমি কেন প্রোগ্রামিং শিখতে পারছি না, এ জন্য দশ-বিশটা কারণ খুঁজে বের করে দেশ-সমাজ-শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদির ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে ঘুরে-বেড়ানোর পরিবর্তে নিজের প্রোগ্রামিং শেখার দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নিতে হবে।
- প্রোগ্রামিং মাত্র তিন ক্রেডিট কিংবা ল্যাবসহ পাঁচ-ছয় ক্রেডিটের কোর্স হলেও প্রথম সেমিস্টারের ৬০-৭০% সময় প্রোগ্রামিং বই পড়া, শেখা ও চর্চা করার পেছনে দিতে হবে। পরীক্ষার আগের রাতের পড়া দিয়ে প্রোগ্রামিং শেখা যায় না, সপ্তাহে পাঁচ-ছয় দিন নিয়মিতভাবে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা প্রোগ্রামিং নিয়ে কাটাতে হবে।
- প্রোগ্রামিং শিখতে গিয়ে নানান ধরনের বাধার সম্মুখীন হবে, অনেক জায়গায় আটকে যাবে— মনে হবে, আমাকে দিয়ে হবে না। কিন্তু হতাশ হওয়া চলবে না, পর্যাপ্ত সময় দিলে প্রোগ্রামিং শেখাটা সহজ হয়ে যাবে। তাই দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রোগ্রামিং প্র্যাকটিস করতে হবে।
- প্রোগ্রামিং কিছুটা শেখার পরেও যদি ক্লাস টেস্টে কিংবা পরীক্ষায় প্রোগ্রামিং কোর্সে রেজাল্ট খারাপ হয়, তাহলে মন খারাপ করা চলবে না। পরীক্ষায় ভালো করতে হলে শিক্ষকের ক্লাস অনুসরণ করতে হবে, প্রোগ্রামিং বেশি জানলেই যে পরীক্ষায় ভালো ফল আসবে বিষয়টি এমন নয়।
- এক হাজার ভিডিও কিংবা পিডিএফ বই কম্পিউটারে ডাউনলোড করে সময় নষ্ট করা উচিত নয়। প্রোগ্রামিং শিখতে হাজার হাজার বই কিংবা ভিডিও টিউটোরিয়ালের দরকার নেই। দু-তিনটি বই-ই যথেষ্ট।
নন-মেজর সাবজেক্ট
সিএস-এর চার বছরের সিলেবাসের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে নন-মেজর সাবজেক্ট, অর্থাৎ অন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে যেসব বিষয় পড়ানো হয়, সেগুলো। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের অন্ত থাকে না। যেমন– আমাদের এসব সাবজেক্ট পড়ার দরকার নেই, নন-মেজর সাবজেক্টের টিচার ভালো না, নম্বর দেয় না, আমাদের ডিপার্টমেন্টকে দেখতে পারে না ইত্যাদি। কিন্তু আসলে ওসব বিষয়ের ওপর জ্ঞানলাভ করা কম্পিউটার বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। একটা সহজ উদাহরণ দিই। আজকাল শিক্ষার্থীদের মধ্যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং নিয়ে অনেক আগ্রহ। পরিসংখ্যান, সম্ভাব্যতা, ম্যাট্রিক্স, লিনিয়ার অ্যালজেবরা—এসব বিষয় না জানলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স ও মেশিন লার্নিংয়ের মতো বিষয় ঠিকঠাক পড়া যায় না। অথচ শিক্ষার্থীরা এসব বিষয় গুরুত্বসহকারে পড়ে না! তাই নন-মেজর বিষয়গুলো নিয়েও সচেতনভাবে পড়ালেখা করতে হবে। ক্লাসে টিচার পড়ান না, পড়াতে পারেন না কিংবা ক্লাস ঠিকমতো হয় না—এ রকম অজুহাত সত্যি হলেও নিজের ভবিষ্যত গড়ার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। এক্ষেত্রে কোর্সেরা (Coursera) বা এডএক্স (EdX) থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর অনলাইন কোর্স করে ফেলতে পারলে ভালো হয়।
কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিং
বিভিন্ন ওয়েবসাইটে অনেক প্রোগ্রামিং সমস্যা দেওয়া থাকে, যেগুলো সমাধান করে জমা দেওয়া যায় ও ওয়েবসাইটের স্বয়ংক্রিয় বিচারক সেই সমস্যাটির সমাধান সঠিক হলো কি না, সেটি চট করে বলে দেয়। এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করাকে অনেকে কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিং বলে, কারণ বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় এ রকম সমস্যার সমাধান করতে হয়। তো প্রোগ্রামিং সমস্যার সমাধান করা মোটেও সহজ কোনো কাজ নয়, এ জন্য অনেক ধৈর্য ধরে দিনের পর দিন লেগে থাকতে হয়, অনেক পরিশ্রম করতে হয়। তারপরও সবাই যে জাতীয় পর্যায়ে প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় ভালো করবে, এমন নয়। কিন্তু তাতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই, কারণ আসল কম্পিটিশন তো হচ্ছে নিজের সঙ্গে। আজকের তুমি গতকালের তোমার চেয়ে যেন একটু ভালো হও, আর আগামীকালের তুমি যেন আজকের তোমাকে ছাড়িয়ে যাও। আজকাল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শত শত টেকনোলজি প্রতিষ্ঠান তাদের ইন্টারভিউতে এমন সব প্রশ্ন করে, যেগুলো কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিং চর্চা না করলে উত্তর দেওয়া অনেক কঠিন। তাই ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিংয়ের বিকল্প নেই।
হ্যাকাথন, কোডস্প্রিন্ট, প্রজেক্ট
প্রোগ্রামিংয়ে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করার জন্য আজকাল হ্যাকাথন, কোডস্প্রিন্ট, প্রজেক্ট কম্পিটিশন ইত্যাদি আয়োজন করা হয়। এগুলোতে অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রেও অংশগ্রহণই বড় কথা। এসব ইভেন্টে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্য কিন্তু পুরস্কার পাওয়া নয়, বরং নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, দলবেঁধে কোনো কাজ করা, একটা নির্দিষ্ট লক্ষ নিয়ে কাজ করে সেটা শেষ করার চেষ্টা করা এবং নিজের কাজকে অন্যদের সামনে উপস্থাপন করা। কর্মজীবনে প্রবেশ করার আগে এ ধরনের অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের অনেক এগিয়ে দেবে। তাই বলে প্রতি মাসেই এ রকম আয়োজনে অংশ নিতে গেলে লেখাপড়া ও মূল প্রোগ্রামিং চর্চায় ক্ষতি হতে পারে। বছরে দু-তিনবার এ ধরনের আয়োজনে অংশ নেওয়াই যথেষ্ট।
আগামী দিনের প্রযুক্তি
Change is the only constant in life – দার্শনিকদের এই কথাটি প্রযুক্তি বিশ্বের বেলাতে আরো বেশি সত্য। প্রতি পাঁচ বছরেই যেন বিশাল পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে, নতুন প্রোগ্রামিং ভাষা, নতুন ফ্রেমওয়ার্ক, নতুন ডেটাবেজ, ক্লাউড কম্পিউটিং, মেশিন লার্নিংয়ের নতুন নতুন প্রয়োগ, মোবাইল কম্পিউটিং, আইওটি—লিখে শেষ করা যাবে না। এ জন্য দেশের সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির হর্তাকর্তারা প্রায়ই বলেন, আমাদের ভার্সিটিগুলোর সিলেবাস আধুনিক করতে হবে, নতুন নতুন জিনিস শেখাতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু তারা আসলে ভুল বলেন। আগামী দিনের প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার জন্য তৈরি হতে হলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন প্রযুক্তির পেছনে দৌড়ানোটা বোকামি হবে। বরং নিজের ভিত্তিটা অনেক বেশি মজবুত করার পেছনেই জোর দেওয়া উচিত। পাইথন লাইব্রেরি ব্যবহার করে মেশিন লার্নিং করার চেয়ে শিক্ষার্থীদের ডেটা স্ট্রাকচার ও অ্যালগরিদমের ওপর দখল থাকটা বেশি জরুরি। প্রবলেম সলভিং স্কিল থাকাটাও অনেক জরুরি। তবে প্রবলেম সলভিং স্কিল মানে এই নয় যে যেসব প্রবলেম আগে সলভ করা হয়েছে সেগুলো আবার সলভ করতে পারা, বরং নতুন প্রবলেম সলভ করা বা নতুন সমস্যা নিয়ে চিন্তা করার দক্ষতা। সমস্যার সমাধান করতে করতেই এই দক্ষতা তৈরি হবে এবং ভার্সিটির সময়টুকুই এই দক্ষতা তৈরির শ্রেষ্ঠ সময়। তেমনি লেটেস্ট ডেটাবেজ শেখার চেয়ে রিলেশনাল ডেটাবেজের মৌলিক ধারণা আয়ত্বে আনা বেশি জরুরি, নতুন ফ্রেমওয়ার্ক শেখার চেয়ে অবজেক্ট ওরিয়েন্টেড প্রোগ্রামিং শেখাটা বেশি জরুরি। মোটকথা হচ্ছে, নতুন টেকনোলজির পেছনে না দৌড়ে, কম্পিউটার সায়েন্সের মৌলিক বিষয়গুলোর ওপর জ্ঞান ও দক্ষতা তৈরি করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কম্পিউটার সায়েন্সের মূল বিষয়গুলো যাদের কাছে পরিষ্কার থাকবে, তাদের পক্ষে যেকোনো সময় নতুন টেকনোলজি আয়ত্বে আনতে বেগ পেতে হবে না। মনে রাখতে হবে, ভার্সিটি থেকে পাশ করার পরে ক্যারিয়ার কিন্তু ৩০ থেকে ৪০ বছরের। প্রযুক্তি নিয়ে এই দীর্ঘ ক্যারিয়ারের জন্য একটি শক্ত ভিত্তির ওপর নিজেকে দাঁড় করানোটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনীতি-আবহাওয়া-আকাশ-বাতাস ইত্যাদি বিষয়ে দোষারোপ করে ঘুরে বেড়িয়ে লাভ হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কতটুকু জ্ঞান অর্জিত হলো, কতটুকু শেখা হলো – এর ওপরই নির্ভর করবে ভবিষ্যতে নিজের জীবন কেমন হবে। তাই এর দায়িত্ব নিজে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।